নারীবাদঃ প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গ

মাকসুদা আকতার তমা, ঢাবি | প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০০:১৫; আপডেট: ৪ জুন ২০২৩ ১২:২৬

ছবি-অনলাইন থেকে পাওয়া
১ম পর্বঃ  বলা হয়ে থাকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হতে না হতেই এ পৃথিবীতে ইতোমধ্যেই আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে যার নাম "লিঙ্গযুদ্ধ"। এই লিঙ্গযুদ্ধের টার্ম টা বুঝতে হলে সবার আগে জানা প্রয়োজন "নারীবাদ" বা "ফেমিনিজম"। বর্তমান বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের কাছে নারীবাদ খুবই পরিচিত একটি শব্দ। কিন্তু শব্দের সাথে পরিচয় থাকলেও নারীবাদের আদর্শ,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব অল্প মানুষই বিস্তারিত ধারণা রাখেন। হাল ফ্যাশনের কিছু মানুষ "ফেমিনিস্ট" শব্দটাকে গালির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে আর কিছু মানুষ নারীবাদের প্রকৃত উদ্দেশকে বুঝে কিংবা না বুঝে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়েছে। প্রকৃতঅর্থে নারীবাদ এই দুই শ্রেণির কাউকেই প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং নারীবাদ হচ্ছে একটি আদর্শগত বিশ্বাস যে আদর্শ - সমতার কথা বলে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি নারী হোক কিংবা পুরুষ সকলের সমান অধিকার এবং সুবিধা পাওয়ার দাবী রাখে। দেশ-কাল ও প্রয়োজনীয়তা ভেদে নারীবাদের ঢেউ ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে ১ম,২য়,৩য় কিংবা ৪র্থ তরঙ্গ। মতামতভেদে কখনও বা উঠে এসেছে লিবারেল ফেমিনিজম, মার্ক্সীয় ফেমিনিজম, ফিলোসোফিকাল ফেমিনিজম ইত্যাদি। তাই নারীবাদকে পুরোপুরি বোঝার জন্য বিস্তারিত আলোচনা জরুরী।
 
১.নারীবাদের ইতিহাসঃ প্লেটো তার ক্লাসিক প্রজাতন্ত্রে বলেছিলেন যে, প্রাচীন গ্রিস পরিচালনা এবং রক্ষার জন্য মহিলারা পুরুষদের সমান "প্রাকৃতিক ক্ষমতা" রাখেন। প্রাচীন রোমের নারীরা ওপিয়ান আইন নিয়ে একটি বিশাল প্রতিবাদ করেছিল, আাইনে ছিল রোমের নারীরা সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান পণ্য ব্যাবহার করতে পারবে না। রোমান কনসাল মার্কস পোরসিয়াস তখন যুক্তি দিয়েছিলেন, "তারা যখন আপনার সমতুল্য হতে শুরু করবে তখনই তারা আপনার উচ্চপদে পরিণত হবে! ” (ক্যাটোর ভয় সত্ত্বেও আইনটি বাতিল করা হয়েছিল।)
"The book of the city ladies" বইতে , 15 শতকেযা পিজান "স্ত্রী-বিদ্বেষ এবং নারীর ভূমিকাকে চোট করে দেখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। বছরখানেক পরে, আলোকিতকরণের সময় , মার্গারেট ক্যাভেনডিশ, নিউক্যাসল-টু-টিনের ডাচেস, এবং " A Vndication of the Rights of Women"বইয়ের লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্টের মতো লেখক এবং দার্শনিকরা নারীদের জন্য বৃহত্তর সমতার পক্ষে লড়াই করেছিলেন।
 
রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামসের স্ত্রী অ্যাবিগাইল অ্যাডামস বিশেষত শিক্ষা, সম্পত্তি এবং ব্যালটের অ্যাক্সেসকে নারীর সাম্যের সমালোচনা হিসাবে দেখেন। তিনি তার স্বামীকে চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে, "যদি নারীদেরকে যথেষ্ট সম্মান না দেয়া হয় এবং যে আইনে নারীর জন্য আওয়াজ তোলা হবে না, বিশেষ যত্ন এবং মনোযোগ দেয়া হবে না আমরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবো।"
 
অ্যাডামস যে "বিদ্রোহের" হুমকি দিয়েছিল ১৯ শতকের শুরুতে তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক দাবি উঠতে থাকে নারীদের বৃহত্তর স্বাধীনতার, দাসত্বের অবসানের। প্রকৃতপক্ষে, বিলুপ্তিবাদী আন্দোলনের অনেক মহিলা নেতা আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছিলেন যা তারা নিজেরাই পরবর্তীতে উপভোগ করতে পারে নি বলে সমর্থন করার ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর বিড়ম্বনা খুঁজে পেয়েছিল।
 
২.প্রথম তরঙ্গঃ আঠার শতকের শুরুর দিক। নারী প্রাকৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক সাংস্কৃতিকভাবে পুরুষের নিচে- এই চিন্তাটি তখন আরো গভীরভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সে সময়ের খ্রিষ্টান চার্চের শিক্ষা, যারা নারীকে বলত ‘Weaker vessel’। এরকম একটা সময়েই পশ্চিমে ‘নারীবাদ’ (Feminism) শব্দটা বেশ জানান দিয়ে উচ্চারিত হতে শুরু করে।
 
আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে নারীবাদ নিয়ে কিছু লেখা প্রকাশিত হতে লাগল সুইডেন থেকে। Margareta Momma এবং কবি Hedvig Nordenflycht নারীর আইনগত অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। ব্রিটেনে আরেকটু আগেই নারীবাদ আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছিল। সেখানে সতেরশ’র গোঁড়ার দিকেই Mary Asrell কথা বলতে শুরু করেছেন। তার "Some reflections on marriage" বইতে তিনি বললেন, ঈশ্বর নারী ও পুরুষকে একই পরিমান বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়েছেন। পরবর্তীতে প্রায় একই কথা বলেছিলেন আমেরিকান নারী অধিকার কর্মী Judith Sargent Murray। ১৭৯০ এ, তার On the equality of the sexes প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, নারীও পুরুষের মতই বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। ১৭৫০’র দিকে ইউরোপের শিক্ষিত সচেতন নারীরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করলেন। তারা নিজেদের চিন্তা ভাবনা পরস্পরের সাথে ভাগ করতে লাগলেন। এদিকে ১৭৩৪ এ সুইডিশ সিভিল কোর্ট একটি আদেশ দিলেন, অনুমতি ছাড়া কোন স্বামী তার স্ত্রীর সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না। নারীর আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে এটি সেসময় একটি আলোচিত আদেশ ছিল। আঠার শতকে আমেরিকা ও ফ্রান্সের বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন নারীবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ওদিকে ফরাসী দার্শনিক Jean Jacques Rousseau এবং Denis Diderot স্বাধীনতা ও সাম্যের বিরুদ্ধে যায়, এমন নানান সামাজিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করলেন, তর্ক করলেন – Right for Men এর পক্ষে, কিন্তু এসবের মধ্যে তারা অবধারিতভাবে নারীর অধিকারকে অন্তর্ভূক্ত করলেন না। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরাও সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে পশ্চিমের নারীরা তাদের অধিকারের কথা জোর গলায় বলতে শুরু করল। ১৭৯২ এ ব্রিটিশ নারীবাদী লেখক Mary Wollstonecraft লিখলেন তার আলোচিত বই- A Vindication of the rights of women। তিনি নারীর শিক্ষা ও ঘরের বাইরে কাজ করার অধিকারের দাবি তুললেন।
 
নারীবাদের প্রথম তরঙ্গে লড়াইয়ের মূল ইস্যুগুলো ছিল- সম্পত্তির অধিকার, পুরুষের সমান শিক্ষার সুযোগ, বিবাহ ও সন্তান সংক্রান্ত বিষয়ে সমঅধিকার এবং শেষমেষ উনিশ শতকের শেষে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার অধিকার আদায় নারীবাদ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে, যার প্রধান বিবেচ্য ছিল "নারীর ভোট দেবার অধিকার"। শিল্পবিপ্লবের পর পরিবর্তন আসতে শুরু করল। বহু নারী ঘরের বাইরে বের হলেন কাজের জন্য। ফলে নিজেদের রাজনৈতিক সামাজ
আস্তে আস্তে দুর্ভোগে কিছু সাফল্যের সূর্য উঠতে শুরু করে। ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ড প্রথম সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এবং নারীদের ভোট দেওয়ার অধিকার দেয়, তারপরে ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯০৬ সালে ফিনল্যান্ড। সীমিত বিজয়ে যুক্তরাজ্য ৩০ বছরেরও বেশি বয়সী নারীদের ভোটাধিকার দেয় 1918 সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, অনেক নারী সক্রিয়ভাবে সামরিক এবং পাওয়ার শিল্পের কাজে যোগ দিতে আরম্ভ করে যা পূর্বে কেবল পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।"civil right movement" অনুযায়ী নারীরা অদিক সংখ্যক নারীকে কর্মসংস্থানে যোগ দিতে উৎসাহ দিতে শুরু করে।পাশাপাশি সমান বেতনের দাবিও ওই সময় উচ্চারিত হতে থাকে।
১৯৬৩ সালে পাস হওয়া "Equal pay act" মূলত এই আন্দোলনেরই সফলতা।
৩.দ্বিতীয় তরঙ্গঃ এরই ধারাবাহিকতায় নারীবাদ প্রবেশ করে তার ২য় ধারায়।কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ শুরু হওয়ার পরপর নারীরা অনুধাবন করতে থাকে যে ত্যাগ তিতিক্ষার পরে তারা এখানে আসার সুযোগ পেয়েছে তার যথাযথ মূল্য তাদেরকে দেয়া হচ্ছে না। যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে চরম পর্যায়ের অসহযোগিতার শিকার হতে হচ্ছে তাদেরকে। ফলে তারা অনুধাবন করে সমতার এ আন্দোলন এখনও শেষ হয় নি।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত দ্য ফেমিনিন মিস্টিক এর লেখক বেটি ফ্রাইডেন যিনি "National Organisation for Women" এরও কো ফাউন্ডার ছিলেন তিনি বলেন, "নারীরা এখনো ঘরের কাজ ও বাচ্চা লালন পালনে পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হয়"।
এই সময়ের মধ্যে, অনেকই নারীবাদকে "নারী মুক্তি" হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করেন।
১৯৭১ এ, গ্লোরিয়া স্টেইনেম "National Women's Politiacal Caucus" প্রতিষ্ঠায় বেটি ফ্রিডান ও বেলা আবজগ এর সাথে যোগদান করেন। "স্টেইনেমস মিস ম্যাগাজিন" ১৯৭৬ সালে প্রথম নারীবাদকে তাদের পত্রিকার প্রধান ফিচার হিসেবে প্রকাশ করে।
১৯৭২ সালে "Equal Right Amendment" নারীদের জন্য আইনগত সমতা চায় এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করে।একই সালে কংগ্রেসে দাবিটি পাস হলেও সংরক্ষণশীল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার দরুণ অনেক রাজ্যে তা অনুমোদিত আইনে পরিণত হয় না। এক বছর পরে, সুপ্রিম কোর্ট নারীদের স্বাধীনভাবে গর্ভপাতের অনুমতিতে রায় দেয়।এবং এই রায়ের নেপথ্যেও ছিলেন একজন নারী 'জন বেডার গিন্সবার্গ'।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পরে, এদেশের নারীদের হয়তো নারীবাদের ১ম তরঙ্গের প্রধান চাওয়া "ভোটাধিকারের অধিকার" এর জন্য লড়তে হয় নি।কিন্তু এর পরবর্তী ঢেউগুলো এদেশের নারীদেরকেও আলোড়িত করে। (এ সম্পর্কে পরবর্তী পর্বে আলোচনা চলবে)
 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top