থাকব না'ক বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে
নারীকথন | প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০২০ ০৩:২৯; আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ ২২:৫৭

মা, বন্ধুদের সাথে ট্যূরে যাবো। -অসম্ভব।
মা, শুধু বান্ধবীরা কয়েকজন মিলে ট্যূরে যাব। -কোনো ছেলে নাই?
তাহলে তো যাওয়াই যাবে না।
মা,বন্ধু-বান্ধবী, সিনিয়র-জুনিয়র সবাই যাচ্ছে। এবার ট্যূরে যাই? -কি দরকার বাপু আমাদের এতো টেনশন এ ফেলার! একেবারে না হয় বিয়ের পর যাস!
প্রতিটা দৃশ্য উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত -মধ্যবিত্ত সকল বাঙালি মেয়ের কিছু স্বপ্ন কিংবা ইচ্ছেকে মেরে ফেলার এক একটা দীর্ঘ হতাশার গল্প। তবে আজ একটি আশার গল্প বলবো। সাথে কিছু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও থাকবে আর থাকবে এক দুঃসাহসিক অভিযানের টানটান উত্তেজনা। আমরা ছিলাম ৮ জন। আমি,শান্তা আপু, নিপা আপু, নীলা আপু, শম্পা আপু, নিথিয়া, মিথিলা আর লীনা। রাত ১০ টার আগ মুহূর্তেও জানতাম না আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি কিন্ত সংকল্পবদ্ধ ছিলাম আজ রাতে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাবই যাবো। শান্তা আপুই প্রথমে বান্দরবানের বগালেক আর কেওক্রাডং ট্রেকিং এর কথা বলে। চাঁদনী রাতের লোভে আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাই। সময়টা ছিল ২০১৯ সালের ২১ মার্চ। যেহেতু একদম সাডেন প্লান তাই সায়দাবাদ এ টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি কোনো ননএসি কোচের সিট খালি নাই। তারপর একরকম বাধ্যহয়েই এসি কোচের ৮ জনের টিকেট কাটি।
শুরু হয় আমাদের জার্নি। বরাবরের মতো বাসের মধ্যে আমাদের স্বভাবসুলভ হাসাহাসি আর গান চলতে থাকে আর সাথে আমার কর্কশ কণ্ঠের কবিতাময় গান তো ফ্রী! ভোর ৬ টায় আমরা বান্দরবানের রুমা বাজার পৌঁছে যাই। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি ভাড়া করে যাত্রা শুরু হয় বগালেকের উদ্দেশ্যে। ট্যূর গাইডের সাথে শান্তা আপু আগেই কথা বলে রেখেছিল।আমাদের ট্যূর গাইড শাহাদাত ভাই ছিলেন খুবই চমৎকার একজন মানুষ আর সাথে সাব্বির নামের আরেকটা পিচ্চি ছিল।ওইটা তো পুরাই একটা বিচ্ছু কিন্তু খুবই সাহসী। চান্দের গাড়িতে করে পাহাড়ের রাস্তায় যাওয়া -এক অসাধারণ অনুভূতি। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একই সাথে সাজেক, নীলগিরি-চিম্বুকের রাস্তায় যাওয়ার ফিল পাওয়া যায়। মাঝখানে রাস্তায় আর্মি ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে এন্ট্রি করতে হয়। সর্বশেষ আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রির আগে যে একটা ঢালু পথে বেয়ে উঠতে হয় তা এক বিশাল ভয়ানক অভিজ্ঞতা। কয়েকজন কে তো রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয় ভর কমানোর জন্য। যাইহোক সকাল ১০ টা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই বগালেকে।
বগালেকঃ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ ফিট উপরে আনুমানিক ২০০০ বছর পুর্বে সৃষ্টি হয়েছিল এই লেক। ভূতত্ত্ববিদদের মতে মৃত কোন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা উল্কাপিন্ডের পতনের কারনে এই লেক সৃষ্টি হয়েছে। বগালেক ১১৫ ফিট গভীর এবং পানি অনেক শীতল। বগালেকে গোসল করার অনুমতি থাকলেও সাঁতার কাটার অনুমতি নেই। যদিও পানিতে নামার পর এই অনুমতিকে আমরা থোরাই কেয়ার করি। কিন্ত শান্তা আপু বারবার আমাদের দূরে না যেতে সতর্ক করে দিচ্ছিল। আমরা যত না বেশি দূরে যাচ্ছিলাম তার চাইতে বেশি চিল্লাচিল্লি আর হাসি-তামাশা করছিলাম। তো তাই শুনে ক্যাম্প থেকে একজন আর্মি ছুটে এসে রাগারাগি করতে যাচ্ছিল কিন্তু আপুর কাছে ধমক খেয়ে ব্যাটা পলায়ন করছে। (যদিও ধমক দেয়ার কারণ ছিল। শুধু মেয়েরা যেখানে গোসল করছে সেখানে হুট করে সে চলে আসতে পারে না। যেহেতু তাকে বলাই হয়েছে আমরা কিনারেই থাকবো,দূরে যাবো না) বগালেকের শীতল পানিতে গোসল করলে সারাদিনের ভ্রমনক্লান্তি নিমিষেই দুর হয়ে যায়।
আমরা সিয়াম দিদির লেকপারের কটেজে ছিলাম। আর খাওয়াদাওয়াও সব ওখানে ছিল। এরপর ফ্রেশ হয়ে বগালেকের আশেপাশে ঘুরতে যাই। সন্ধ্যার সূর্য ডোবার পর পরই আমার বহুল আকাঙ্খিত চাঁদের দেখা পাই। যদিও উঠবে না উঠবে না বলে নীলা আপু, শম্পা আপু আর নিথিয়া আমার সাথে খুব একটা মজা নিয়ে নেয়! এরপর চাঁদের মায়াবী আলোতে কটেজের বারান্দায় বসে শুরু হয় আমাদের গানের আসর। শিল্পী নিথিয়ার সুন্দর গলার গানের চাইতে কখনও কখনও আমার কর্কশ গলার আওয়াজই বেশি শোন যাচ্ছিল। ওইদিন আমাদের ৮জনের মেয়েদের গ্রুপ ছাড়া বাকি সব গুলোই ছিল ছেলেদের গ্রুপ। তো মধ্যবয়সীদের এক গ্রুপ আমাদের মজা করা দেখে খুব একটু আলাপ জমানোর পায়তারা করছিল কিন্ত আমাদের এক একজনের ঝাড়ির কারনে কেউ আর ঘাটানোর সাহস করে নাই। রাতে কটেজের লেক সাইডের বারান্দায় চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি একদম খেয়াল ছিলনা। পরের দিন সকালে শুরু হয় কেওক্রাডং অভিযান।
কেওক্রাডংঃ কেওক্রাডং বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২৩৫ ফুট(৯৮৬ মিটার) উঁচুতে এর অবস্থান। এক সময় এটিকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ধরা হত। তবে আধুনিক গবেষণায় এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাকা হাফং। কেওক্রাডং শব্দটি মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় কেও মানে 'পাথর', কাড়া মানে 'পাহাড়' আর এবং ডং মানে 'সবচেয়ে উঁচু'। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়। বগালেক থেকে কেওক্রাডং এর ১৫ মিটার পথ পুরোটাই ট্রেকিং করে (পায়ে হেঁটে) যেতে হয়। আমাদের প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। অন্যান্য গ্রুপের ছেলেগুলো বারবার ঘুরেফির একই কথা বলছিল যে, জাস্ট একটা মেয়েদের গ্রুপ এই দুর্গম পথে আসছে তাও আবার এতো দ্রুত ট্রেকিং করছে! ট্রেকিং এর পথে একটা ঝর্ণা পড়ে। নাম তার "চিংড়ি"। জানি না এই নাম কোথা থেকে এসেছে। তবে,আমার ধারণা ঝর্ণার স্রোত খুবই অল্প মানে চিংড়ির মতো সরু আর কি! পুরো ট্যূরে এই পার্টটুকুই আসলে সবচেয়ে কষ্টের আর দুঃসাহসিক ছিল। মোটামুটি সবারই ট্রেকিং এ কষ্ট হচ্ছিল। কেউ প্রকাশ করছিল, কেউ করছিল না কেউ বা হুটহাট বসে পড়ছিল। সবচেয়ে মজার ঘটনা সৃষ্টি হয়েছিল শম্পা আপুকে নিয়ে। বেচারীর জীবনে এই প্রথম বারের মতো পাহাড় ভ্রমণ। তার উপর ৩১৩৫ ফুটের ১৫ কিমি রাস্তা। সে তো একটু পর পর আমাকে রাগাতে রাগাতে শেষ কেন আমি এই জঘন্য স্পট (!) ঠিক করলাম। আর রাতে তার পায়েও ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে পরের দিন সকালে নামার সময় সে একদম ফিট। পাহাড় তাকে এতোই মুগ্ধ করেছে যে ট্রেকিং এ সব দুঃখ-কষ্ট নিমিষেই সে ভুলতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক তাই। আপনি শুধু একবার কষ্ট করে পাহাড়ের কাছে যান, পাহাড়ের চূড়া আপনাকে দ্বিগুণ করে ভালোলাগার অনুভূতি ফিরিয়ে দিবে।
চূড়ায় পৌঁছানোর আগে "দার্জিলিং পাড়া" নামে একটা জায়গা আছে যেখান থেকে চূড়ার ভিউ দেখতে খুবই অসাধারণ লাগে।আমরা অনেকক্ষণ পাড়ার এক দোকানে বসে ছিলাম। এরপর দুপুর ১ঃ৩০ টার দিকে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় পৌঁছাই। ওখানে ৩ টা কটেজ আছে যার মালিক একজনই। খাওয়াদাওয়া সব তার ওখানেই। চূড়ার ওখানে একটা হেলিপ্যাড আছে। ওই পর্যন্তই পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি আছে। এর চেয়ে ভেতরে যাওয়া নিষেধ।
"মাথার উপর মস্ত বড় মালার মতো চাঁদ। চারদিকে জ্যোৎস্নার মায়াবী নৈসর্গিক আলো মাদকতার সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ের উপর ছোট্ট একটা ঘরের ভেতরে চাঁদের আলো আছড়ে পড়ছে।" হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের গল্পের মতো মনে হচ্ছে, তাই না?? ঠিক তাই। ওই রাতটা সত্যিই এরকম মায়াবী ছিল। একদম কল্পনার রূপকথার গল্পের মতো! পরের দিন সকাল সকালই আমরা আবার বগালেকের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উঠতে যত কষ্ট আর আর সময় লাগে নামতে তার অর্ধেকও লাগে না। ঠিক ধরেছেন একদম নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ! দুপুরে বগা লেকে খাওয়াদাওয়া করে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ওখান থেকে আসার আগে অন্যান্য আরও কয়েকটা গ্রুপের সাথে পরিচয় হয়। সবাই মোটামুটি আমাদের সাহস আর আনন্দ করা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছিল। কারণ ওই যে ট্যাবু ধারণা -"শুধু মেয়েদের গ্রুপ একা কোথাও ঘুরতে যায় না"। সমাজের এক অলিখিত নিয়ম। মানসিক ও শারীরিকভাবে তুমি যতই শক্তিশালী হও,আর্থিকভাবে যতই সাবলম্বী হও না কেন কেবল ও কেবলমাত্র "নারী" হওয়ার কারণে সবকিছুতেই "না"।
তবে আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি একদিন এই ঘুণে ধরা সমাজের এইসব বানোয়াট রীতিনীতির পরিবর্তন হবে। মেয়েরা চাইলেই যখন খুশি,যেভাবে খুশি নির্ভয়ে বাইরে যাবে। পার্মিশন নেয়ার সময় মেয়ের মা আর তার মেয়েকে বলবেনা "বাইরের অবস্থা ভালো না,থাক তোর যাওয়া লাগবে না। বরং ছেলের মা তার ছেলেকে বলবে, বাবা যেখানেই যাও না কেন কেনো মেয়েকে দয়া করে উত্যক্ত করো না,প্রয়োজনে বিপদে তাকে সাহায্য করো।"
লেখাঃ মাকসুদা আক্তার তমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: