নিজেই হয়ে উঠুন নিজের ভ্রমণ সঙ্গী

নারীকথন | প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২০ ০১:৩৪; আপডেট: ৭ অক্টোবর ২০২০ ০১:৩৫

২৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পর্যটন, আবাসন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান খাতের অবদান নিয়ে ২০১৬ সালে চারটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে যে মূল্য সংযোজন হয় তার আকার মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) সোয়া ৬ শতাংশ। টাকার অংকে যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোটেল, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ মূল্য সংযোজন হয়। এ ছাড়া জিডিপিতে শুধু পর্যটন খাতের অবদান ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ খাতে কর্মসংস্থান হয় ৮ লাখ ১৬ হাজার মানুষের, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন ছাড়াও এদেশে রয়েছে অসংখ্য নয়নাভিরাম পাহার পর্বত সহ প্রত্যতাত্ত্বিক নিদর্শন। বর্তমানে বাংলাদেশে ভ্রমণপিয়াসীদের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে, ফলশ্রুতিতে বেড়ে চলেছে বিভিন্ন রকম ট্রাভেল এজেন্সি সহ ট্রাভেল প্যাকেজ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন অনেক বেশি ভ্রমণে আগ্রহী। আর্থিকভাবে সাবলম্বী কিংবা ভ্রমণে অনেক বেশি আগ্রহ থাকলেও দেখা যায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা ঘুরতে যেতে পারে না সঙ্গীর অভাবে। এছাড়াও নিরাপত্তার প্রশ্ন তো বরাবর লেগেই আছে। নারীদের ভ্রমণ নিয়ে বর্তমানে অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- সাবরা মেহেরিন ফেসবুক ভিত্তিক নারী ভ্রমণকারীদের সংগঠন “ওয়ান্ডার উইমেনের” প্রতিষ্ঠাতা। ডা. সাকিয়া হক এবং ডা. মানসী সাহা মিলে ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত করেন ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ– ভ্রমণকন্যা’। নারী ভ্রমণকারীদের একত্র করা এবং যেসব নারী ভ্রমণ করতে চাইলেও বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যেতে পারেন না, তাদের প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ– ভ্রমণকন্যা’। সংগঠনটি ইতোমধ্যে শুধু মেয়েদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৬৯টি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।ডা. সাকিয়া হক এবং ডা. মানসী সাহা দুজনে মিলে স্কুটি চেপে ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইতোমধ্যেই দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের সময় দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মেয়েদের ভ্রমণ, নারীর স্বাস্থ্য এবং আত্মরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা ক্যাম্পেইনও চালিয়েছেন তারা।

বিশ্বের একশোটিরও বেশি দেশে ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশী আরেক নারী নাজমুন নাহার। সুইডেন প্রবাসী এই নারী নিজের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ১১০টি দেশ সফর করেছেন। এসময় তিনি সাথে করে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের পতাকা। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যের সারমর্ম এক এবং সেটি নারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিয়ে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে অনেকবেশি শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান শান্ত নারীদের ভ্রমণ বিষয়ে বলেন, “নারীরা এখন শিক্ষা, কর্ম ও সামাজিকভাবে অনেক অগ্রসর হয়েছেন। ফলে নারীদের ভ্রমণেও অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে পর্যটন স্পটগুলোকে আরও বেশি নারীবান্ধব করতে হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশে নারী সদস্য নিয়োগ করতে হবে। পর্যটন খাতের অন্যান্য সেবাগুলোতেও বেশি সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ জরুরি। একজন নারী যখন দেশের মধ্যে নিরাপদে একাই ভ্রমণ করতে পারবেন, তখন বিদেশি পর্যটকরা আরও বেশে আকৃষ্ট হবেন”। গতবছর এক জরিপ নারীদের ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ফিনল্যান্ড,কানাডা, নিউজিল্যান্ড, উরুগুয়ে, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, আইসল্যান্ড,জাপান ও চিলি এই ১০ টি দেশ।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে, নারীর ক্ষমতায়নের ৫টি অন্যতম উপায় হিসেবে “ভ্রমণকে” ধরা হয়েছে-

ক) ভ্রমণ আত্মবিশ্বাস বাড়ায়ঃ একটি নতুন স্থান যেকোনো মানুষকেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা দেয়।যেকোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের উপায় বলে দেয়।আর সেটি যদি হয় একজন নারীর “একার” ভ্রমণ তবে এটি তাকে আরও বেশি আত্নবিশ্বাসী করে তোলে। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং নিজেকে নতুনভাবে চেনার সুযোগ করে দেয়।

খ) ভ্রমণ পরিচিতি বাড়ায়ঃ স্বাভবিকভাবে যে সকল মানুষ ভ্রমণ পিয়াসু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা একই রকম হয়।তাই সহজেই যেকোনো নতুন জায়গায় গেলে এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে।আর এটি যদি একজন নারীর একার ভ্রমণ হয় তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার পরিচিত মানুষ বাড়বে।নতুন নতুন কমিউনিটির সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হবে।সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এখন নারীদের জন্য ভ্রমণকন্যাসহ আরও অনেক ট্রাভেল গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা নিয়মিত ট্যূরের আয়োজন করে।

গ) ভ্রমণ অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দেয়ঃ ইউএন ওয়ার্ল্ড ট্যূরিজম অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট মতে,ট্যূর গাইডরা প্রাথমিকভাবে পুরুষ হলেও বর্তমানে নারী ট্যূর গাইড নিযুক্ত করা উচিত। এবং তারই লক্ষ্যে মেক্সিকোর ট্রাভেল কোম্পানি “Eat Like a Local” দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী গাইড নিয়োগ দিয়েছে। “Naya Traveler” বিভিন্ন ভ্রমণের আয়োজন করেছে যাদের ৮০% হোস্ট ই নারী। এমনকি আমাদের দেশেও বগা লেকে যে ২-৩ টি কটেজ রয়েছে তার মালিক এবং খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন নারীরাই। তাই শুধু বান্দরবানের বগা লেক নয় কক্সবাজার -সেন্টমার্টিন-সাজেকসহ অন্যান্য ট্যূরিস্ট স্পটে নারীদের নিজস্ব হোটেল, রেস্টুরেন্টের ব্যাবসাকে প্রমোট করা প্রয়োজন।

ঘ) ভ্রমণ নারীকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দেয়ঃ সম্প্রতি ইউএন স্বীকার করেছে যে, এসডিজি অর্জনের জন্য নারীর ক্ষমতায়নকে বাস্তবায়ন করা জরুরী। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল ও ট্যূরিজম কাউন্সিলের মতে, বিশ্বের ১০ ভাগের ১ ভাগ চাকরির এখন ভ্রমণ কেন্দ্রিক। গত দেশ বছরে, ট্যূরিজম সেক্টরে নারীর ভূমিকা অনেক বেড়েছে। শুধু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টুরিজম ডিপার্টমেন্ট বৃদ্ধি নয় বরং প্রান্তিক অঞ্চলে এই সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহন ই পারবে বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে।

ঙ) ভ্রমণ মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলেঃ ইউএন দেখিয়েছে, মেয়েরা যখন উপার্জন করে তখন তারা চায় জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে। তাই তারা তাদের কমিউনিটির শিক্ষার হার তথা মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে। ভ্রমণ পিয়াসু নারীরা চায় প্রান্তিক অঞ্চল তথা পর্যটন অঞ্চলের শিশুরা শিক্ষিত হয়ে উঠুক। এই লক্ষে তারা নিজ উদ্যোগেই ব্যাবস্থা গ্রহণ করে।

তাই বর্তমান বিশ্ব তথা বাংলাদেশের সার্বিক বিবেচনায় মেয়েরা এখন চাইলেই ট্যূর দিতে পারে, গ্রুপ কিংবা একাই। হয়তো সময় অনুযায়ী অনেক সময় ট্যূর দেয়ার জন্য সঙ্গী পাওয়া যায় না। তবে কিছু বিষয় মাথায় রেখে ট্যূর প্লান করলে এখন নিজেই নিজের ভ্রমণসঙ্গী হওয়া যায়। যেমন-

১.যে স্থান ভ্রমণের জন্য নির্বাচন করবেন তার সম্পর্কে ডিটেইলস তথ্য আগেই জেনে রাখুন। হোটেল, ঘোরার স্থান এবং সর্বোপরি মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা কেমন।

২.ভ্রমণের জন্য যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। লোকাল লোকজনের সাথে পরিচয় রাখুন কিংবা বন্ধু অথবা পরিচিত মহলের কেউ ওই অঞ্চলে থাকলে তাদের সাথে যোগাযোগ করে রাখুন।

৩.যতটা সম্ভব ব্যাগ হালকা রাখা জরুরি। দিন অনুযায়ী সীমিত সংখ্যক জামা-কাপড় প্যাক করুন। এতে অতিরিক্ত বহনের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকবেন। বিশেষ করে পাহাড় কিংবা ঝর্ণা ট্রেকিং এ ব্যাগের আকার ছোট রাখা বাঞ্ছনীয়।

৪.পরিচয়পত্র, প্রয়োজনীয় ওষুধ, নিজের একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে কখনও ভোলা যাবে না। আর একা ট্যূরের জন্য পাওয়ার ব্যাংক,চার্জার এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

৫.দামী জিনিসপত্র যেমন সোনার গহনা,ল্যাপটপ এগুলা না নেয়াই ভালো। ডিএসএলআর নিলেও সাবধানে রাখতে হবে। সর্বোপরি, ভ্রমণ হয়ে উঠুক সকলের আনন্দের। যান্ত্রিক জীবন থেকে একটুখানি বস্তির জন্য অবশ্যই ভ্রমণ একটি অপরিহার্য উপাদান। আর একা একা ঘুরতে পারবো না বলে কোথাও যাবো না-ও সময় হয়েছে এই ধারণা থেকেও নারীদের বের হয়ে আসার।

লেখাঃ মাকসুদা আক্তার তমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top