নারীর একা ভ্রমণ নিষিদ্ধ! অতঃপর...

নারীকথন | প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর ২০২০ ০১:১৯; আপডেট: ৭ অক্টোবর ২০২০ ০১:৩৫

নারীর একা ভ্রমণ? নিষিদ্ধ, অসম্ভব। আজ শোনাবো এই অসম্ভবকে সম্ভব করা এক সফল নারীর গল্প। বাংলাদেশ পাসপোর্ট হাতে নিয়ে (প্রথম নারী) হিসেবে মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১০০ টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। বাঙ্গালী মেয়েরা টাকা হলে শাড়ী কেনে,আমি টিকিট কিনি। আমি কাজী আসমা আজমেরী। জন্ম ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৮৭, কুমিল্লায়। বেড়ে ওঠা খুলনায়। পড়াশোনা শেষ করেছি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে। কাছের বন্ধু ২৬ টি দেশ ভ্রমণ করেছে সেই গল্প শুনতে তার বাসায় যাওয়া।

অপলক দৃষ্টি তে ভ্রমণ গল্প শুনতে শুনতে একসময় বলে ফেলি আমিও বিশ্ব ঘুরবো। বন্ধুর মা হাসির ছলে বলে তুমি মেয়ে পারবে নাহ। তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের পর স্বামী অনুমতি দিবে নাহ। কথাটা খুব গায়ে লেগেছিলো আমার। আমিও উত্তর স্বরূপ বলি আন্টি মেয়েদের টিকিটের দাম কি ছেলেদের টিকিটের দামের চেয়ে বেশী? আমি যদি চাই আমার হাসবেন্ড কি বাধা দিবে? প্রতিজ্ঞা করলাম ৫০ টি দেশ সলো ট্রাভেল করে তারপর বিয়ে করবো। স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম বিশ্ব জয়ের। ভ্রমণের জন্য আর্থিক জোগাড় দরকার ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কোম্পানিতে চাকরী করতাম। প্রথম ভ্রমণ শুরু করি ২০০৯ সালে। নিজের গয়না বিক্রি করে ৩৮০০০০ টাকা পাই।৮০০০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে রওনা হই নেপালের উদ্দেশ্য। এয়ারপোর্টে কিছু ফরেনার ট্রাভেলাদের সাথে পরিচয় হয়। তারপর থেকে স্বপ্ন পূরণে আর পিছন ফিরে তাকাই নি আমি।

তবে স্বপ্ন পূরণের পথ এতো মসৃণ ছিলো নাহ। নানা প্রতিবন্ধকতা,সমালোচনা,বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আজ আমি জাতিসংঘে স্বকৃীত প্রাপ্ত ১৯৩ দেশের মধ্যে সর্বোমোট ১১৫ টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে বাংলাদেশ আমাকে না চিনুক,আমি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে চিনিয়ে দিতে চাই এই মনোবল নিয়ে ভ্রমন করতে সক্ষম হয়েছি। তবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বিশ্ব জয় করা অন্য দেশগুলোর পাসপোর্ট ধারীদের চেয়ে অনেক কঠিন। ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী ভিয়েতনামে (২৩ ঘন্টা) এবং একই সালের ১০ মে (২৭ ঘন্টা) সাইপ্রাসের ডিপোর্টেড জেলে ছিলাম। আমার অপরাধ ছিলো শুধুমাত্র বাংলাদেশ পাসপোর্টধারী একজন ভ্রমণকারী। গলা ধাক্কা দিয়ে আমাকে জেলে ঢুকানো হয়।

সেদিন মনে জেদ হয়েছিলো ভীষণ। বাংলাদেশী পাসপোর্ট এতটাই দুর্বল। এতো প্রতিকূল থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেউ আটকাতে পারেনি। জীবিকার জন্য নিউজিল্যান্ডে থাকি। সিকাগো তে বাড়ি আছে। ২০১২ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসে কাজ করি বেশ কয়েক বছর হলো। চেষ্টা করলে হয়তো ইউরোপীয় পাসপোর্ট পেতাম। কিন্তু কখনো চেষ্টা করিনি, দেশের পাসপোর্টেই নিজের পরিচয় দিতে ভালো লাগে।’ আমি মনে করি আমার এই জয় বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জয়। ফরেনার বন্ধু কে বেড়াতে নিয়ে আসি দেশে। ঢাকার বিভিন্ন প্রদর্শনী স্থান ঘুরে দেখা শেষ করে চলে যাই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হাজীর বিরিয়ানি খেতে। সেখানে এক ভদ্র লোক এসে বলেন আপনাদের বিলটা আমি দিতে চাই। আমার মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। সে আমাকে আপনার নিউজ দেখিয়ে বলেছে বাবা বড় হয়ে আমি বিশ্ব ঘুরতে চাই এই আপুর মতো। সে একাই ৬৩ টা দেশ ভ্রমণ করেছে দেখো। তখন মেয়েকে বলি ভালোভাবে পড়াশোনা করো তাহলেই বিশ্ব ঘুরতে পারবে। এই ঘটনা সেদিন আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো।

২০১৫ সালে “ভয়েস অফ আমেরিকা” আমাকে নিয়ে একটি প্রোগ্রামের করে যা দেশের ৫ টি ন্যাশনাল টিভিতে প্রচার করা হয়। এই নিউজে সেই ছোট্ট সোনামণি আমাকে দেখে তার বাবার কাছে বিশ্ব ঘোরার আবদার করে। আমার এই পথচলায় যেমন ছিলো নানা বাধা বিপত্তি অপরদিকে আছে নানা মজার অভিজ্ঞতার কথা। সলো ভ্রমণে সবথেকে বেশী বিপদে পড়তে হয় ভাষা নিয়ে। এমন হয়েছে কেথাও ঘুরতে গিয়েছি আমাকে জিজ্ঞেস করছে তোমার নাম কি? আমি উত্তর বলছি দেশের নাম। একবার চাইনিজ এক বন্ধুকে নিয়ে টেক্সি ভাড়া করছি। আমাকে বলছে ভাড়া ১৫ টাকা, আমি না বুঝে বললাম ২০ টাকার কমে যাবো নাহ। ২০১১ সালে জার্মানের বার্লিনে ট্রামে করি যাচ্ছি ধাক্কা খাচ্ছি আর ধাক্কা খাচ্ছি। জার্মানের ইংরেজী ভাষা তেমন কেউ বোঝে নাহ উল্টোদিকে আমি জার্মানি ভাষা জানি নাহ তাই ভাবলাম ধাক্কা খাওয়া শ্রেয়। ২০১৮ থেকে ২০২০ মুজিবর্ষের মধ্যে ইচ্ছে আছে ১০০০০০ লক্ষ্য তরুণদের কাছে আমার স্লোগান টা পৌঁছে দিবো। ” travelling is fun way to learn”.

যারা তরুণী ট্রাভেলার আছে তাদের জন্য আমার উপদেশ থাকবে নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে,স্বাধীনতা সম্পর্কে জানো। সলো ট্রাভেলিং করলে নিজেকে জানা যায়। আত্নবিশ্বাসী হয়ে ওঠা যায়,একা চলার স্বাধীনতা পাওয়া যায়,সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় নাহ। সহজেই যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারা যায়। পৃথিবী অনেক সুরক্ষিত, শুধু একবার নিজ ঘর থেকে,নিজ দেশ থেকে বের হও। এতোদিন কত ভুল করেছো জানতে পারবে। আমি চাকরি করেছি দেড়বছর বাকি ৬ মাস জমানো টাকায় ট্রালেভিং করেছি। বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড সাহায্য করবে বলে ৩ মাস অপেক্ষা করিয়েছে কিন্তু কোনো স্পন্সর কিংবা সাহায্য আমি পাই নি। বাংলাদেশ সরকার যদি youth exchange কে সাপোর্ট করে তাহলে হয়ত আমার মতো অনেকেই নিশ্চিতে সলো ট্রাভেল করতে পারবে। আসছে ২৭ সেপ্টেম্বর টুরিজম দিবসে আমার প্রতিপাদ্য বিষয় থাকবে সকল নারী যেন স্বাধীনতা পায়। পুরুষের মতো নারীদের ও নিজের মতো জীবন উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। পরিবার থেকে সবচেয়ে বেশী সহোযোগিতা পেয়েছি। তাই প্রতিবেশী,আত্নীয় স্বজন কিংবা বন্ধু বান্ধবের নেতিবাচক মন্তব্য আমাকে থামাতে পারিনি। শুধু বাংলাদেশে নয়,আফ্রিকা,ইরান,মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোতেও যারা সলো ট্রাভেলিং করতে চায় আমাকে দেখে মোটিভেড হউক। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পতাকা,বাংলাদেশের ঐতিহ্য পৌঁছে দেওয়া আমার মূল লক্ষ্য। বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই শুধু শ্রমিক হিসেবে,কাজের জন্য বাঙ্গালীরা বিদেশে পাড়ি জমায় নাহ,ভ্রমণকারী হিসেবেও যায়।

লেখাঃ সুরাইয়া সম্পা, ইডেন মহিলা কলেজ।



বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top