06/04/2023 প্রথম বাঙালী মুসলিম নারী চিকিৎসক জোহরা বেগম কাজী।
নারীকথন
৬ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৩৫
মাদারীপুরের কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামের কাজী পরিবারের যেই ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরেই যে ভেঙে গেছে এই উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক ট্যাবু তার নাম জোহরা বেগম কাজী। বাবা ডাক্তার কাজী আবদুস সাত্তার ও মা মোসাম্মদ আঞ্জুমান নেসার ঘরে ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবরে জন্ম প্রথম আধুনিক বাঙালি এই মুসলিম মহিলা চিকিৎসকের। স্কুল জীবন থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধার অধিকারী। জীবনে কখনো দ্বিতীয় হননি এই নারী। তিনি আলীগড় মুসলিম গার্লস কলেজে পড়াশুনা করেন। এরপর ভর্তি হন 'লেডিহার্ডিং মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন্স' এ। এটি এশিয়া মহাদেশের MBBS লেভেলে পড়ার মতো প্রথম নারীদের মেডিকেল কলেজ। জোহরা কাজী ছিলেন এই কলেজের প্রথম ব্যাচের এবং একমাত্র মুসলিম ছাত্রী।
তিনি MBBS পরীক্ষা দিয়ে সেসময় সর্বভারতীয় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রি 'এফআরসিওজি' লাভ করেন। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার ভেঙে মানবকল্যানমূলক সমাজ গঠনের যে আদর্শ তিনি স্থাপন করেছেন তা আমাদের সকলের জন্য এক অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। স্ত্রীরোগ নিয়ে যে ভয়ংকর কুসংস্কার এই উপমহাদেশে ছিল তার খোলস ভেঙে এক নবযাত্রার দ্বার উন্মোচন করেন জোহরা বেগম কাজী। অনগ্রসর সমাজের গর্ভবতী মহিলারা হাসপাতালে এসে পুরুষ ডাক্তারদের নিকট চিকিৎসা নিতে আসতেন খুব কম।এর ফলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকাল মৃত্যুর ঘটনা ছিল অহরহ। তিনি ইয়োথমাল উইমেন্স (পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর 'সেবাগ্রামে' অবৈতনিক চিকিৎসাসেবা দিতেন।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। পশ্চাৎপদ দেশে এসে প্রসূতি নারীদের এই সীমাহীন দুর্ভোগ দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম গাইনি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজেও গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (CMH) অনারারি কর্নেল হিসেবেও গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। তিনি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসেবেও দায়িত্বরত ছিলেন। কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ভূষিত হয়েছেন নানান পদক ও খেতাবে। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ভূষিত হয়েছেন 'তখমা-ই পাকিস্তান' উপাধিতে।তাকে 'ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা' নামেও অভিহিত করা হয়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর 'একুশে পদক' প্রদান করেন। ক্ষণজন্মা এই মহীয়সী নারী সান্নিধ্য পেয়েছেন কালজয়ী অনেক ব্যক্তির।
মহাত্মা গান্ধী এই মহীয়সী নারীকে কন্যাতুল্য মনে করতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা হামিদ খান ভাসানীর মতো কিংবদন্তী ব্যক্তিদের সাহচর্য লাভ করেছেন। শুধুমাত্র চিকিৎসাক্ষেত্রেই তার বিচরণ ছিল না, তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তার অবদান বিমোহিত করে। তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়িটি তিনি মুক্তিসেনাদের গোপনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানী আর্মিদের কাছে জবাবদিহিতা তাঁর করতে হয়েছিল। বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজসংস্কারক,আজীবন মানবসেবায় নিয়োজিত প্রথম বাঙালি এই মুসলিম নারী ২০০৭ সালের ৭ই নভেম্বর ঢাকায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখাঃ ফারজানা আকতার নিপা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।