ঢাকার নারী বাইকার, চ্যালেন্জ ও সম্ভাবনা।
মাহিয়া লোবা, ঢাকা। | প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:০৯; আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:৪৫

ইশরাত খান মজলিস, থাকেন ঢাকার টিকাটুলি, কর্মস্থল গুলশান ১, পেশায় তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। রোজ সকালে স্কুটি চালিয়ে ছুটে চলেন অফিসে।
ঢাকার রাস্তায় এবং ঢাকার বাইরেও বর্তমানে প্রায়ই দেখা মেলে এমন নারী বাইকারদের। যাদের ৮৫% কর্মজীবী নারী। ঢাকার রাস্তায় নারী বাইকারদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কয়েক বছর আগেও রাস্তায় নারী বাইকারদের দেখা পাওয়া ছিলো বিরল ঘটনা। কিন্তু বর্তমানে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে। যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে এবং পরিবেশ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে দিন দিন নারীরা স্কুটির প্রতি ঝুঁকছেন।
এ সম্পর্কে ইশরাত খান মজলিস বলেন, 'আমার অফিসে যাওয়ার সময় বাসে চলাফেরায় নানান হয়রানি ও নেতিবাচক ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো। তখন মনে হতো এভাবে আর পারছি না। তখন আমার হাসবেন্ড এর সাপোর্ট থাকায় এবং তার সহায়তায় স্কুটিটি কিনি। তবে স্কুটি চালাতে গিয়ে রাস্তায় প্রথম দিকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ ছেলেরা অনেক উত্যক্ত করতো। সরু রাস্তাগুলো দিয়ে যেতে গেলে ছেলেরা ইচ্ছে করে ফেলে দিত। কোন নারী পুরুষকে ছাড়িয়ে সাইড কেটে বাইক নিয়ে এগিয়ে গেছে এটা যেন তারা মানতেই চাইতো না
কোন কোন জায়গায় ছেলেরা বাইক নিয়ে ধাওয়া করতো।সমাজ ও আত্মীয়স্বজন স্কুটি চালানোকে দেখতো যেন কোন প্রথা ভাঙার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে।
এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি লেডি বাইকারদের সাপোর্ট দিতে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করি "Bangladesh Women Riders Club (BWRC) নামের প্রতিষ্ঠান।বর্তমানে এর সদস্য প্রায় ৩০০ জন।
ঢাকার রাস্তায় ইশরাত খান এর মতো লেডি বাইকারদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে।
এ প্রতিবেদকের কথা হয় লেডি বাইকার নার্গিস সুলতানার সঙ্গে, তাঁর মতে তিনি বাইকে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।এটা তাঁর সময় এবং টাকা বাঁচাচ্ছে। গণপরিবহনে চলাচল নারী বান্ধব না হওয়ায় যৌনহয়রানি, বাসে সিট পাওয়া, ভিড় ঠেলে বাসে উঠা ইত্যাদি নেতিবাচক পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় প্রতিটা মেয়ের। এসব নেতিবাচক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই নারীদের পছন্দের জায়গায় স্থান পাচ্ছে স্কুটি।
ইয়াসমিন জাহান একজন লেডি বাইকার, পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার। তিনি বলেন,অফিস যাবার জন্যই মূলত স্কুটি কেনা। কারণ বাসে করে অফিস এ যাওয়াটা মেয়েদের জন্য একটা বিশাল সমস্যা। কিন্তু আমি যখন স্কুটি নিলাম তখন আমার জীবনটা যেন অনেক সহজ হয়ে গেলো। এখন অনেক সহজেই নিজেকে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। আর টেনশন করিনা কিভাবে যাবো কার সাথে যাবো। তাই আমি মনে করি নারীদের উচিত স্কুটি নিয়ে জীবন টাকে সহজ করে তোলা।
ইলমা জেবরিন জানান,অনেকে মনে করেন টমবয় টাইপের মেয়েরা নাকি বাইক চালায়। ধারণাটি আসলে ঠিক নয় আমি পর্দার ভেতরে থেকেই কিন্তু অনায়াসে বাইক চালাচ্ছি। আমার আশেপাশের মানুষের ধারণাও পাল্টে দিতে পেরেছি।
নারীরা এখন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ এর মাধ্যমে নারীদের সেবাও দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে রোকসানা ইসলাম বলেন, আমার মা প্রথমে এক্সিডেন্ট এর ভয়ে রাজি ছিলেন না।কিন্তু আমি আমার অদম্য ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে পারিনি। আসাদগেট এর এক পরিচিত আপুর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে "ও বোন" এ জয়েন করি। এমজিএইচ এর কোম্পানি হচ্ছে "ও ভাই" এটার অংশ "ও বোন" রাইড শেয়ারিং অ্যাপ।এখন পর্যন্ত ২০ জনের অধিক নারী "ও বোন" এ সক্রিয় এবং ৫০ জনের বেশি নারী নিবন্ধিত। আয় কিন্তু খারাপ না মাস শেষে পঁচিশ হাজার টাকা। এখন বাবা মাও আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। আশেপাশে যারা নেতিবাচক কথা বলতেন তারাই কিন্তু এখন প্রশংসা করছেন।
শাহনাজ পারভিন বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া, বাজার করা,অফিস করা ইত্যাদি সকল কাজ সহজে ও স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারছেন স্কুটি থাকার কারণে।
নুসরাত জাহান ইনফো বাংলাকে বলেন, বাইক চালিয়ে ঢাকার রাস্তায় ছুটে চলার সময় নিজেকে অনেক স্বাধীন লাগে,কনফিডেন্স বেড়ে যায় কয়েকগুণ। নারী বাইক চালনার প্রশিক্ষণ দিতে "যাবো বহুদূর" নিয়ে কাজ করছেন আতিকা রোমা। তাঁর মতো আরও অনেক নারী বাইকার খুলেছেন নারীদের স্কুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বি আর টি এ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে,২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটর সাইকেল এর ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন ২২,৭৩৩ জন নারী।এতেই বোঝা যায় সড়কগুলোতে নারী বাইকারদের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।
মাইয়া মানুষ হোন্ডা চালায় না, এটা ব্যাটাদের কাজ।এমনসব হাজারো নেতিবাচক কথা এবং নানান প্রতিকূল পরিবেশ জয় করে ঢাকার রাস্তায় এখন অনেক নারীকে দেখা যায় রংবেরঙের স্কুটি চালাতে। ধীরে ধীরে এটি এখন শহরের রাস্তায় স্বাভাবিক দৃশ্য হয়ে গেছে।
সরকারের কাছে বর্তমান নারী বাইক রাইডার এবং যারা স্কুটি কিনতে আগ্রহী কিন্তু টাকার স্বল্পতার জন্য পারছেন না তাঁদের দাবি নারীদের যদি সহজ কিস্তিতে বাইক কেনার সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং রাস্তাঘাট এ চলাচল নারী বান্ধব করা হয় তাহলে অনেক নারীর ক্ষেত্রেই স্কুটি নিয়ে রাজপথে বের হওয়াটা সহজ হতো
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: