দরকার বেপক সচেতনতা।

জরায়ু ক্যান্সার; লক্ষণ ও চিকিৎসা।

সুরাইয়া সম্পা, ইডেন মহিলা কলেজ। | প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২০ ০০:৫৩; আপডেট: ৪ জুন ২০২৩ ১৪:০৯

ছবিঃ ইন্টারনেট
ক্যান্সার শব্দটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষের মাথায় সম্ভবত ভীতিকর কিছুর অনুভূতি হয়। কিন্তু এর সাথে যখনি "জরায়ু মুখ" শব্দটি যুক্ত হয় তখন অনেকেই এ নিয়ে কথা বলায় যেন সংকোচ বোধ করেন। আর এর সাথে যৌন সম্পর্কের বিষয়টি যুক্ত থাকায় সে নিয়ে কথা বলায় রয়েছে আরও আড়ষ্টতা। এমনকি চিকিৎসকেরাও তার বাইরে নন। প্রতিবছর গোটা পৃথিবীতে প্রায় ২,৫০,০০০ নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে "দ্বিতীয়" প্রধান ক্যান্সার হলো জরায়ু ক্যান্সার।আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা এজেন্সি সাম্প্রতিক এক জরীপে বলছে, বাংলাদেশে বছরে "সাড়ে ছয় হাজারের"বেশি নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। আর আক্রান্ত হচ্ছে ১২ হাজারের ও বেশী।
 
জরায়ু ক্যান্সার কী?
এর প্রকারভেদঃ জরায়ুর ক্যান্সার যা গর্ভাশয় ক্যান্সার নামেও পরিচিত। সাধারণত জরায়ুর নিচের সরু অংশ যা জরায়ুর মুখ বা সারভিক্স বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। যোনিপথের ওপরের অংশ থেকে শুরু করে জরায়ুর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অংশটি বিস্তৃত। জরায়ু কলা থেকে উদ্ভূত যেকোন ধরনের ক্যান্সারই জরায়ুর ক্যান্সারের অন্তর্ভুক্ত। বেশ কয়েক ধরনের ক্যান্সার এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যার মাঝে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পরিচিত "সার্ভিকাল ক্যান্সারও" (সাধারণত জরায়ুর নিচের সরু অংশ থেকে উদ্ভূত) রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মহিলাদের মধ্যে যে ক্যান্সার অধিক পরিমাণে দেখা যায় তার মধ্যে এটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। "এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার "(বা জরায়ুর ভিতরের আবরণের ক্যান্সার) দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ক্যান্সার, এবং উন্নত দেশগুলির নারীদের মধ্যে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আধিক্য বেশি হওয়ায় এটি বিশ্বব্যাপী এটি চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
 
**এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ুর ভেতরের আবরণ) গ্রন্থিগুলোর কোষ থেকে এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমাসের সৃষ্টি হয়। যার মাঝে সহজে চিকিৎসাযোগ্য এন্ডোমেট্রোয়েড এডেনোকার্সিনোমা, ছাড়াও ইউটেরিন প্যাপিলারি সেরোস কার্সিনোমা এবং ইউটেরিন ক্লিয়ার-সেল কার্সিনোমার মত ভয়াবহ ক্যান্সার অন্তর্ভুক্ত।
 
**এন্ডোমেট্রিয়াল স্ট্রোমাল সারকোমার উৎপত্তি এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ুর ভেতরের আবরণ) সংযোজক কলা থেকে, তবে এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমাসের তুলনায় এর বিস্তার অনেক কম।
 
**ম্যালিগন্যান্ট মিক্সড মুলেরিয়ান টিউমার অত্যন্ত বিরল এন্ডোমেট্রিয়াল টিউমার যেখানে গ্ল্যান্ডুলার (কার্সিনোমাটাস) এবং স্ট্রোমাল (সার্কোম্যাটাস) উভয় বিভাজন লক্ষ্য করা যায় - কার্সিনোসারকোমা উচ্চতর কার্সিনোমার মতো আচরণ করে।
 
**সার্ভিকাল ক্যান্সার: জরায়ুর নিচের অংশের সাথে যোনির উপরের অংশের সাথে সংযোগ সৃষ্টিকারি জরায়ুমুখের ক্যান্সার।
 
**ইউটেরিন সারকোমা: মায়োমেট্রিয়ামের সারকোমা, বা জরায়ুর পেশী স্তর, সাধারণত লেইওমায়োসারকোমাস।
 
**গর্ভকালীন ট্রফোব্লাস্ট রোগ: গর্ভাবস্থার কলা থেকে উদ্ভূত নিউপ্লাস্টিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে সম্পর্কিত যা প্রায়শই জরায়ুতে অবস্থিত।
 
জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তের কারণঃ "বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি" নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ এম এ হাই বলছেন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তের পেছনে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা একটি সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে।
**বাংলাদেশে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে আর ঘন ঘন সন্তান জন্মদানকেই বলা হচ্ছে এর প্রধান কারণ। তিনি বলছেন, "আমাদের কালচারাল বিষয় হল এখানে অল্প বয়সে বিয়ে হয় আর অনেক বাচ্চা হয়। এত অল্প বয়সে সবকিছু ঠিকমতো গঠনই হয়নি। তারমধ্যেই যৌন সঙ্গম আর খুব অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া। এতে জরায়ু মুখের উপর অনেক চাপ পড়ে। "যেহেতু তারা অপুষ্টিতে ভোগে তাই তাদের সেরে উঠতে সময় লাগে। তাতে দেখা যাচ্ছে জরায়ু মুখের রিপেয়ারটা ভালোমতো হয়না।এভাবে বারবার বাচ্চা হতে গিয়ে যদি বারবার ড্যামেজ হয় তাহলে ঐখানে একটা অ্যাবনরমাল সেল তৈরি হতে পারে।"
 
তিনি আরও বলছেন, "অর্থনৈতিক" কারণও আছে। যেমন মেয়েরা যারা খাটাখাটি করে ফ্যামিলিতে হয়ত তাদের ঠিকমত দেখাশোনা করে না। তাদেরকে সময়মত ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়না।" "সে নিজে অর্থের অভাবে যেতে পারে না। আর বাংলাদেশে নারীদের স্বভাবই হল সবাই খাওয়ার পরে কিছু থাকলে খায় না থাকলে খায়না। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণের সাথে শিক্ষারও একটি বিষয় রয়েছে। তিনি বলছেন, তারই করা এক গবেষণায় তিনি দেখেছেন বাংলাদেশে যৌনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে শিক্ষার মারাত্মক অভাব। বাংলাদেশে গ্রামে ৭৫ শতাংশ নারীর জরায়ু-মুখে ইনফেকশন আছে। এর কারণ হচ্ছে সেক্সুয়াল অর্গানের পরিচ্ছন্নতার অভাব। এই পরিচ্ছন্নতা তাকে নিজেকে যেমন বজায় রাখতে হবে তেমনি তার পুরুষ সঙ্গীকেও সমানভাবে রাখতে হবে।
 
তবে ডাঃআফরোজা খানম হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, দেশে মেয়েরা রূপচর্চার জন্য যে সময় ও অর্থ ব্যয় করে সেটি যদি তারা নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য করতো। চেহারা দেখা যায় তাই আমরা তার পেছনে সময় দিচ্ছি। কিন্তু আমার জরায়ু আমাকে মা হতে সাহায্য করে। এটির গুরুত্ব তাদের বোঝা উচিৎ। এর বাইরে যেসব নারীর বহু পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক, তারা রয়েছেন বেশি ঝুঁকিতে। অথবা যেসব পুরুষের অনেক যৌন সঙ্গী রয়েছে তারাও নারী সঙ্গীদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলছেন। "বহুগামিতা" অন্যতম কারণ
 
লক্ষণ বা উপসর্গঃ জরায়ু ক্যান্সারের প্রাথমিক কিছু লক্ষণ হলোঃ
১. আচমকা ক্ষুধা কমে যাওয়া।
২. সবসময় বমি বমি ভাব কিংবা বার বার বমি হওয়া।
৩. পেটে অতিরিক্ত ব্যথা কিংবা পেট ফুলে থাকা।
৪. গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য। হালকা খাবারের পরও ভরপেট অনুভব করা, পেটে অস্বস্তি লাগা, ইত্যাদি পেটের কোনো সমস্যা খুব বেশি হলে তা জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
৫. যৌনাঙ্গের চারপাশে চাপ চাপ বোধ হওয়া এবং ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা।
৬. অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা হঠাৎ করে ওজন অনেক কমে যাওয়া।
৭. অভ্যস্ত থাকার পরেও যৌনমিলনের সময় ব্যথা অনুভূত হওয়া এবং রক্তস্রাব হওয়া।
৮. অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা।
৯. নারীদের মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পরেও রক্তক্ষরণ হওয়া।
১০.বাদামি দূর্গন্ধযুক্ত স্রাব।
 
চিকিৎসা ও করণীয়ঃ অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার সবচাইতে সহজে নির্ণয় করা যায়। এমনকি হওয়ার আগেই খুব সহজ পরীক্ষায় ধরা যায় ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা। জীবাণু প্রবেশের পর জরায়ু-মুখের ক্যান্সার হতে ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে। যার জন্য আক্রান্ত হওয়ার আগেই চিকিৎসার মাধ্যমে শতভাগ নির্মুল করা সম্ভব।যে দুই প্রকার "প্যাপিলোমা ভাইরাস" দিয়ে এই ক্যান্সার হয়, সহবাসের মাধ্যমেই সেটি স্প্রেড হয়। ভাইরাসটি ঢোকার সাথে সাথেই ক্যান্সার হয় না। অন্য ক্যান্সারে জীবাণুটি ঢোকার পরে সময় খুব একটা পাওয়া যায় না নির্মুলের জন্য তবে নিয়মিত স্ক্রিনিং করালে ইনিশিয়ালি জার্মটা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
 
জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপটি অত্যন্ত সহজ। সময়ও লাগে মাত্র এক মিনিট। স্ক্রিনিংটা খুবই সহজ। কোন যন্ত্রপাতি লাগে না। আমরা সবাই ভিনেগার বা সিরকার সম্পর্কে শুনেছি। সেটি ডাইলুট করে তুলায় লাগিয়ে জরায়ুর মুখে লাগিয়ে এক মিনিট রেখে দিলে যায়গাটা যদি সাদা হয়ে যায় তখন মনে করতে হবে এটি ক্যান্সারের পূর্বাভাস।"সেটি কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে বাকি পরীক্ষা করা হয়। এমনও হয় খুব প্রাথমিক হলে সেখানেই রোগীর জরায়ুতে ইলেকট্রিক সেক দিয়ে দেয়া হয়। সেটাতেও কয়েক মিনিট লাগে। বাংলাদেশের সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি জেলা সদর হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, এমনকি নির্বাচিত কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক ধাপটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অথচ এই তথ্যটি বেশীরভাগ নারীর অজানা। বিবাহিত ও যৌন সংসর্গ আছে এমন নারীরা সিরকা দিয়ে পরীক্ষার সহজ এই ধাপটি করিয়ে নিলেই জেনে যাবেন তার এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। বয়স ত্রিশ হওয়ার পর থেকে প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর একবার এই পরীক্ষাটি করিয়ে নিতে বলেন চিকিৎসকেরা।
 
জরায়ু ক্যান্সার একমাত্র ক্যান্সার যার টিকা রয়েছে। টিকা দিয়ে জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। সাধারণত ১২-১৫ বছরের মেয়েদের এই টিকা দেওয়ার কথা বলা হলেও ৩০ বছর পর্যন্ত অবিবাহিত মেয়েদের এই টিকা দেওয়া হয়।এইচপিভি-১৬ ও এইচপিভি-১৮-এর প্রতিষেধক টিকা (সারভারিক্স) এবং এইচপিভি-১৬, ১৮, ১১ ও ৬-এর প্রতিষেধক টিকা নেওয়া হলে শরীরে উল্লিখিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়। জরায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডি তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এছাড়া কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি হয়ত ক্যান্সার সেরে যায়; কিন্তু রোগীরা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগে।তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এবং সচেতনা আপনাকে দিতে পারে জরায়ু ক্যান্সার ঝুঁকি মুক্ত জীবন।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top