বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর।
নভেরা রহস্য!
আয়শা আকতার সুমি, ঢাবি। | প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০২০ ০০:১৫; আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৪৪

আজ এখানে নভেরা যা করছেন, তা বুঝতে আমাদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে - ১৯৬০ সালে নভেরার এক প্রদর্শনীর পুস্তিকায় শিল্পাচার্য জয়নুল তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন। এই নভেরাই যে আমাদের দেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর, তাঁকে নিয়ে বিদগ্ধ বাঙালি সমাজে আগ্রহের শেষ নেই। ১৯৯৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা নামে একটি উপন্যাস ছাপা হলে প্রায়-বিস্মৃত এই শিল্পীর জীবনের কিছু অধ্যায় নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে যায়।
চট্টগ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে ২৯ মার্চ ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন নভেরা আহমেদ। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কলকাতা, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে। পারিবারিক পরিবেশ অন্যান্য সমসাময়িক পরিবারের চেয়ে উদার ও আধুনিক চিন্তা-ভাবনা সম্পন্ন হওয়ায় নভেরা নাচ, গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করতেন। বাবার অবসর গ্রহণের পর সবাই আদি নিবাস চট্টগ্রামে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন নভেরা। এ সময় নজরুলের এক জন্মোৎসবে নভেরা চট্টগ্রামের জুবিলি হলে এক ঘণ্টা নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।
জয়জয়ন্তী রাগে মিউজিক বাজানো হয়েছিল, পরিচালনায় ছিলেন তরুণ লেখক সুচরিত চৌধুরী। শোনা যায়, অল্প বয়সেই এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাবা-মা তাঁকে আবার বিয়ের জন্য চেষ্টা চালান তবে তিনি বিয়েতে রাজি হননি। ১৯৫০ সালে নভেরা লন্ডনে যান। ১৯৫১ সালে নভেরা ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হলেন। ১৯৫৫ সালে নভেরা লন্ডনের ক্যামবারওয়েল কলেজ অব আর্টস থেকে মডেলিং এবং ভাস্কর্য বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময় তিনি লন্ডনে শিল্পী ও ভাস্কর হামিদুর রহমানের সাথে দেখা করতে আসেন। ১৯৫৫ সালে ডিপ্লোমা শেষে তিনি প্রফেশনাল দক্ষতা অর্জনের জন্য ফ্লোরেন্স এবং ভেনিসে চলে যান। সেখানে তিনি প্রখ্যাত স্থপতি ভেটোরিনো ভেনচুরির তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন।
ইচ্ছা করলে সেখানেই থেকে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু হামিদুর রহমানের সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এই কিংবদন্তী। সে সময় নভেরা আহমেদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক কাজ করেন যা পরবর্তীতে স্থাপত্য জগতে তার জাত চিনিয়ে দেয়। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ১০০ টির বেশি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন তিনি। নভেরা আহমেদের প্রথম প্রদর্শনী ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। তার পরবর্তী প্রদর্শনী ছিল ১৯৬১ সালে লাহোরে। প্রথম দিকে নভেরা আহমেদ পাথর, কংক্রিট এবং মাটি দিয়ে জ্যামিতিক আকৃতির মানুষ এবং প্রাণীর ভাস্কর্য তৈরি করেতেন। লোহা, ইস্পাত এবং ব্রোঞ্জ ব্যবহার শুরু করেন পরে। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর বিমানের ভাঙ্গা অংশ ব্যবহার করে এবং স্প্রে পেইন্টিং এর মাধ্যমে ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তার কাজে বিভিন্ন স্থান, দ্বীপ, আকাশ, ফিনিক্স, ফুল, জল, রোদ, চাঁদ এবং মানবিক দিকগুলোর প্রকাশ এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
এদিকে ১৯৫৭ সালেই নভেরা ও হামিদ শহীদ মিনারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু সরকারি খাতায় নভেরার নাম না থাকায় শহীদ মিনারের নকশা পরিকল্পনায় তাঁর অবদানের প্রসঙ্গটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান শহীদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করার অনুরোধ করেন প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে। তবে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন জারি হলে, এই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে শুধুমাত্র হামিদুর রহমানকেই শহীদ মিনারের স্থপতির মর্যাদা দেওয়া হয়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক যে আমরা নভেরা আহমেদকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। নভেরা সর্বপ্রথম এই ধারণাটির প্রচলন করেছিলেন যে ভাস্কর্য বাড়ির বাইরে স্থাপন করা যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে নভেরা আহমেদ তেজগাঁয়ে শিল্পপতি এম আর খানের বাসভবনের সামনে ‘পরিবার’ নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার রীতি এই ভাস্কর্যটি স্থাপনের মাধ্যমেই শুরু হয়। এর নাম ছিল 'কাউ এন্ড টু ফিগার্স'।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট তৎকালীন কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে, পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতি এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে নভেরার একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়।এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান। এই প্রদর্শনীর শেষে, পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের আমন্ত্রণে নভেরা লাহোর যান। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে অল পাকিস্তান পেইন্টিং এন্ড স্কালপ্চার এক্সিবিশান-এ নভেরার তৈরি 'চাইল্ড ফিলোসফার' ভাস্কর্যটি প্রথম পুরস্কার পায়। এই ভাস্কর্যটি ক্রয় করেছিলেন পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী মমতাজ দৌলতানা। এই বছরের শেষের দিকে তিনি নাচ শেখার জন্য ভারতে যান। ভারত থেকে ফিরে তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তানের লাহোরে কাটান। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েৎনামের যুদ্ধের বিষয়ে জানার জন্য, তাঁর এক ফটোগ্রাফার বন্ধুকে নিয়ে ব্যাঙ্কক যান। এই বছরের অক্টোবর মাসে তিনি ব্যাঙ্ককে একটি একক ভাস্কর্য প্রদর্শনের আয়োজন করেন। ব্যাংকক থেকে তিনি প্যারিসে চলে যান ওই বছরেই। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে তাঁর একটি ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়। এরপর থেকে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
১৯৭৩ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ভাস্কর্যের পরিবর্তে ছবি এঁকে কাটিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে নভেরার দেখা হয়, তিনি তাঁর জন্য একটি সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুদান কার্যকর হওয়ার আগেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। প্যারিসে থাকাকালে ১৯৮৪ সালে গ্রেগরি দ্য ব্রুহনসকে বিয়ে করে ফ্রান্সের নিভৃত পল্লিতে লোক চক্ষুর অন্তরালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে একুশে পদকের জন্য নির্বাচিত হন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং এর পর থেকে তিনি হুইল চেয়ারেই কাটাতেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মে তিনি প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। নভেরার ভাস্কর্য তৈরির মূল প্রবণতা ছিল ‘ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন’ এবং প্রধান বিষয়বস্তু ছিল নারীর প্রতিমূর্তি। তথাকথিত ভাস্কর্য শিল্পে আমরা ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীর যে রোমান্টিসিজম দেখি, নভেরার তৈরি ভাস্কর্যগুলো এই বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত এবং অনেক বেশি মেদহীন, ঋজু। তাঁর ভাস্কর্যে মূর্ততার চেয়ে বেশি জোর দিতেন বিমূর্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে। নভেরার ভাস্কর্যের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’, ‘মা ও শিশু’, ‘এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’, ‘পরিবার’ (১৯৫৮), ‘যুগল’ (১৯৬৯), ‘ইকারুস’ (১৯৬৯), ‘জেব্রা ক্রসিং’ (১৯৬৮) ইত্যাদি।
১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্যারিসে নভেরার বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ৪৩টি চিত্রকর্মের খোঁজ মেলে। তাঁর কাজের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ বিদ্যমান ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে, এ ছাড়া প্যারিসে গ্রেগরি দ্য ব্রুহনসের স্টুডিওতে নয়টি ভাস্কর্য ও ৪৩টি চিত্রকর্ম রয়েছে। মানুষ মরে গেলে হয়তো দাম রেখে বা বাড়িয়ে যায় তার। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা হয়তো নভেরা আহমেদ কে পেয়েছি কথা সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই রচিত জীবনীভিত্তিক উপন্যাস ‘নভেরা’ (প্রকাশকাল-১৯৯৪), এন রাশেদ চৌধুরীর প্রামাণ্যচিত্র ‘শিল্পী নভেরা আহমেদের সৃজন ভুবন ন হন্যতে’ (১৯৯৯) ও চয়ন খায়রুল হাবিবের কবিতা ‘নভেরায় হংসনিল’।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: